আজকের ডিজিটাল যুগে তথ্যের প্রবাহ এতটাই দ্রুত যে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এই প্রক্রিয়ায় একটি দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করছে—একদিকে এটি জীবনকে সহজ করছে, অন্যদিকে ভুয়া খবর ছড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
AI-এর উন্নত প্রযুক্তি, যেমন ডিপফেক, স্বয়ংক্রিয় কন্টেন্ট তৈরি, এবং অ্যালগরিদম-চালিত বিস্তার, মিথ্যা তথ্যকে আরও বিশ্বাসযোগ্য এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে।
এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে দেখব কীভাবে AI ভুয়া খবর ছড়াতে সাহায্য করতে পারে এবং এর পিছনে কী কী ঝুঁকি রয়েছে।
AI-এর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ভয়ঙ্কর হাতিয়ারগুলোর মধ্যে একটি হলো ডিপফেক। এটি মেশিন লার্নিং এবং নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভিডিও, অডিও বা ছবি তৈরি করে, যা দেখতে বা শুনতে একেবারে বাস্তব মনে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, একজন রাজনীতিবিদের মুখ বা কণ্ঠস্বর নকল করে এমন একটি ভিডিও তৈরি করা যেতে পারে যেখানে তিনি এমন কথা বলছেন যা তিনি কখনো বলেননি।
২০২০ সালে ভারতের একটি ডিপফেক ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে একজন সেলিব্রিটির মুখ ব্যবহার করে অশ্লীল কন্টেন্ট তৈরি করা হয়েছিল।
এই ধরনের কন্টেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয় এবং এটি সত্য বলে বিশ্বাস করে।
AI-চালিত ভাষা মডেল, যেমন GPT-3 বা এর উন্নত সংস্করণ, অত্যন্ত দ্রুত এবং প্রচুর পরিমাণে লিখিত কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে। এই মডেলগুলো এমনভাবে লেখা তৈরি করে যে তা মানুষের লেখার মতোই স্বাভাবিক এবং বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। ভুয়া খবর ছড়াতে চাইলে কেউ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাজার হাজার নিবন্ধ, পোস্ট বা মন্তব্য তৈরি করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো গুজব ছড়ানোর জন্য AI দিয়ে শত শত ভুয়া খবরের শিরোনাম তৈরি করে সেগুলো বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এর ফলে মানুষের মনে সন্দেহ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
AI শুধু কন্টেন্ট তৈরি করেই থেমে থাকে না, এটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদমকে কাজে লাগিয়ে ভুয়া খবরের বিস্তার ঘটাতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, AI-চালিত বটগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্ট শেয়ার, লাইক বা কমেন্ট করতে পারে, যা কোনো মিথ্যা খবরকে ভাইরাল করে তুলতে সাহায্য করে।
২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত বটগুলো AI ব্যবহার করে ভুয়া খবর ছড়িয়েছিল, যা লাখো মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করেছিল।
এই বটগুলো এতটাই দক্ষ যে তারা মানুষের আচরণের নকল করে এবং সাধারণ ব্যবহারকারীদের থেকে আলাদা করা কঠিন।
AI ব্যবহারকারীদের ডেটা বিশ্লেষণ করে তাদের পছন্দ, বিশ্বাস এবং দুর্বলতা বুঝতে পারে। এরপর এটি ব্যক্তিগতকৃত ভুয়া খবর তৈরি করে যা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ব্যক্তির জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ ধর্মীয় বিষয়ে সংবেদনশীল হয়, তবে AI তার জন্য ধর্মীয় গুজব বা ভুয়া খবর তৈরি করতে পারে। এই কৌশলটি মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যাকে আরও কার্যকরভাবে ছড়ায়।
AI-এর একটি বড় সুবিধা হলো এর গতি। যেখানে একজন মানুষের একটি ভুয়া খবর লিখতে এবং ছড়াতে সময় লাগে, সেখানে AI সেকেন্ডের মধ্যে হাজার হাজার পোস্ট তৈরি করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারে। এই দ্রুততার কারণে সত্য যাচাই করার আগেই মিথ্যা তথ্য লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, COVID-19 মহামারীর সময় AI-চালিত সিস্টেম ভুয়া চিকিৎসা পরামর্শ এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে দিয়েছিল, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
AI-এর এই ক্ষমতা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতির উপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ভুয়া খবরের কারণে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, সামাজিক অস্থিরতা, এমনকি সহিংসতাও সৃষ্টি হতে পারে।
২০১৮ সালে মিয়ানমারে ফেসবুকে ছড়ানো ভুয়া খবর রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছিল, যেখানে AI-চালিত অ্যালগরিদম এই তথ্যের বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল।
AI-এর এই অন্ধকার দিক মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
প্রথমত, AI-এর নৈতিক ব্যবহারের জন্য কঠোর নিয়মনীতি প্রণয়ন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ডিপফেক শনাক্তকরণ প্রযুক্তি উন্নত করা এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করা দরকার।
তৃতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর উচিত AI-চালিত বট এবং ভুয়া কন্টেন্ট শনাক্ত করার জন্য আরও কার্যকর সিস্টেম তৈরি করা।
AI একটি অসাধারণ প্রযুক্তি, কিন্তু এর অপব্যবহার ভুয়া খবর ছড়ানোর ক্ষেত্রে এটিকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। ডিপফেক থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় কন্টেন্ট তৈরি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম—AI-এর এই সক্ষমতা আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে।
এই প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে হলে আমাদের এর ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং দায়িত্বশীলভাবে এটি ব্যবহার করতে হবে।