07 Apr
07Apr

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আজকের বিশ্বে প্রযুক্তির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। AI-এর মাধ্যমে তৈরি ছবি ও ভিডিও—যেমন ডিপফেক, জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্ক (GAN) দিয়ে তৈরি কন্টেন্ট—বিনোদন, শিল্প ও ব্যবসায়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আইনি ও নৈতিক প্রশ্নও উঠে এসেছে। 

কে এই কন্টেন্টের মালিক? এটি কি গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে? ডিপফেকের অপব্যবহার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? 

এই নিবন্ধে আমরা AI-জনিত ছবি ও ভিডিওর আইনি দিকগুলো বিশ্লেষণ করব।


১. AI-জনিত কন্টেন্ট এবং কপিরাইট আইন

AI দিয়ে তৈরি ছবি বা ভিডিওর ক্ষেত্রে প্রথম যে প্রশ্ন ওঠে, তা হলো কপিরাইট। যদি একটি AI সিস্টেম একটি ছবি বা ভিডিও তৈরি করে, তবে তার মালিক কে—AI-এর স্রষ্টা, ব্যবহারকারী, নাকি AI নিজে? বর্তমান আইনি কাঠামোতে এর উত্তর স্পষ্ট নয়। 

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বানরের তোলা সেলফির কপিরাইট নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। আদালত রায় দিয়েছিল যে, প্রাণী কপিরাইটের মালিক হতে পারে না। 

একইভাবে, AI একটি অ-মানবীয় সত্ত্বা হওয়ায় এর সৃষ্ট কন্টেন্টের কপিরাইট সাধারণত ব্যবহারকারী বা AI-এর ডেভেলপারের কাছে যায়।কিন্তু জটিলতা তৈরি হয় যখন AI বিদ্যমান কাজ থেকে শিখে নতুন কন্টেন্ট তৈরি করে। 

যেমন, যদি একটি AI প্রচুর শিল্পীর কাজ থেকে ডেটা নিয়ে একটি নতুন ছবি তৈরি করে, তবে মূল শিল্পীদের কি কোনো অধিকার থাকবে? 


২. ডিপফেক এবং গোপনীয়তা লঙ্ঘন

ডিপফেক প্রযুক্তি AI-এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যা ব্যক্তির মুখ বা কণ্ঠস্বর নকল করে ভুয়া কন্টেন্ট তৈরি করে। এটি গোপনীয়তার জন্য গুরুতর হুমকি। 

উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে ভারতে একজন সেলিব্রিটির ডিপফেক ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, যা তার সম্মানহানি করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়ার মতো রাজ্য ডিপফেক নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করেছে। 

২০১৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার AB 730 আইন পাশ হয়, যা নির্বাচনের সময় ডিপফেক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে।


৩. মানহানি এবং আইনি দায়বদ্ধতা

AI-জনিত ছবি বা ভিডিও যদি কাউকে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করে, তবে তা মানহানির (defamation) কারণ হতে পারে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন ওঠে—দায়ী কে? যদি একটি AI স্বয়ংক্রিয়ভাবে কন্টেন্ট তৈরি করে, তবে কি ব্যবহারকারী, ডেভেলপার, নাকি প্ল্যাটফর্ম দায়ী হবে? 


৪. সাইবার অপরাধ এবং AI-এর অপব্যবহার

AI-জনিত কন্টেন্ট সাইবার অপরাধের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে। 

উদাহরণস্বরূপ, ভুয়া ভিডিও বা ছবি ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেলিং, প্রতারণা বা জালিয়াতি করা যায়। 

২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে একটি ঘটনায় AI-চালিত ভয়েস ক্লোনিং ব্যবহার করে একজন ব্যবসায়ীকে প্রতারিত করা হয়েছিল। 


৫. আন্তর্জাতিক আইনি প্রেক্ষাপট

AI-জনিত কন্টেন্টের আইনি দিক শুধু একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের GDPR (General Data Protection Regulation) ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষার উপর জোর দেয়। যদি কোনো AI ইউরোপীয় নাগরিকের ডেটা ব্যবহার করে ডিপফেক তৈরি করে, তবে তা GDPR লঙ্ঘন হতে পারে, যার জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। 


৬. নৈতিকতা এবং আইনের মধ্যে ভারসাম্য

AI-এর আইনি দিক শুধু আইন দিয়ে সমাধান করা যায় না, এর জন্য নৈতিকতারও প্রয়োজন। AI ডেভেলপারদের উচিত এমন সিস্টেম তৈরি করা যা অপব্যবহার রোধ করে। 

উদাহরণস্বরূপ, OpenAI-এর মতো সংস্থা তাদের মডেলের অপব্যবহার রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। একইভাবে, সরকার ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে।


সমাধানের পথ

AI-জনিত ছবি ও ভিডিওর আইনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

  • নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন: ডিপফেক এবং AI-জনিত কন্টেন্টের জন্য আলাদা আইন তৈরি করা।
  • প্রযুক্তিগত সমাধান: ডিপফেক শনাক্তকরণ সফটওয়্যার উন্নত করা।
  • জনসচেতনতা: মানুষকে AI-জনিত কন্টেন্ট সম্পর্কে সচেতন করা।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: সাইবার অপরাধ রোধে দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো।

উপসংহার

AI দিয়ে তৈরি ছবি ও ভিডিও একদিকে যেমন সৃজনশীলতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি আইনি ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। 

কপিরাইট, গোপনীয়তা, মানহানি এবং সাইবার অপরাধের মতো বিষয়গুলো এই প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত। বর্তমান আইনি কাঠামো এই নতুন প্রযুক্তির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। 

তাই, আইনের সঙ্গে নৈতিকতা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, যাতে AI-এর সুবিধা গ্রহণ করা যায় এবং এর অপব্যবহার রোধ করা যায়।

মন্তব্য
* ইমেলটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে না।