মধ্য এশিয়ার অন্যতম রহস্যময় দেশ হলো তুর্কমেনিস্তান। এটি একটি প্রাচীন ইতিহাসের দেশ, যেখানে প্রাচীন সিল্ক রোডের অবশিষ্টাংশ থেকে শুরু করে আধুনিক ভবনের স্থাপত্য, সবই একত্রে দেখা যায়। দেশটির বিস্তৃত মরুভূমি, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং অনন্য সংস্কৃতি পর্যটকদের কাছে দিন দিন আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
আশগাবাত, তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী, একটি আধুনিক এবং স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত শহর। পুরো শহরটি মূলত সাদা মার্বেলের স্থাপত্যের জন্য খ্যাত, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে। আশগাবাতের আধুনিক ভবন এবং এর সৌন্দর্য এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেয়।
এই শহরের অন্যতম আকর্ষণ হলো নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার এবং মহান নেতা নিদানশাহ এর বিশাল প্রতিমা, যা আধুনিক তুর্কমেনিস্তানের প্রতীক। এছাড়া শহরে বিভিন্ন বড় বড় বাগান এবং ফোয়ারা রয়েছে, যা শহরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়।
তুর্কমেনিস্তানের অন্যতম আকর্ষণ হলো প্রাচীন সিল্ক রোড, যা পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবসার অন্যতম প্রধান রাস্তা ছিল। এই রোডের পথ ধরে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার অবশিষ্টাংশ আজও দেখা যায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো মারভ শহর, যা একসময় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শহর ছিল এবং ইসলামি জগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
মারভের ধ্বংসাবশেষগুলি আজও পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যেখানে ইসলামী স্থাপত্যের চিহ্ন এবং প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখা যায়।
তুর্কমেনিস্তানের মরুভূমির মাঝে একটি বিস্ময়কর প্রাকৃতিক স্থান হলো দরভাজা গ্যাস ক্রেটার, যা সাধারণভাবে পরিচিত নরকের দরজা নামে। এটি ১৯৭১ সালে একটি গ্যাসফিল্ডে দুর্ঘটনার কারণে তৈরি হয়েছিল এবং তারপর থেকেই এটি জ্বলছে। ৭০ মিটার প্রশস্ত এবং ৩০ মিটার গভীর এই ক্রেটারটি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এর আলোকিত দৃশ্য রাত্রে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা দেয়, যা মরুভূমির নৈঃশব্দ্যে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
ছবি: সংগৃহীত
তুর্কমেনিস্তানের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হলো কারাকুম মরুভূমি, যা দেশটির বেশিরভাগ অংশজুড়ে বিস্তৃত। এই মরুভূমি কেবল তার বিশালত্বই নয়, বরং এর বালির ধোঁয়া এবং মিরাজের জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত। এখানকার বন্যপ্রাণীও বৈচিত্র্যময়, যেখানে উট, বন্য শিয়াল, এবং নানা প্রজাতির পাখি দেখা যায়।
তুর্কমেনিস্তানের সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরোনো এবং এতে প্রাচীন তুর্কি, পারস্য, এবং ইসলামি ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ রয়েছে। তুর্কমেন কার্পেট বিশ্ববিখ্যাত, যা তাদের জটিল নকশা এবং হস্তশিল্পের নিদর্শন। এছাড়াও, তুর্কমেনিস্তানে প্রতি বছর কার্পেট উৎসব আয়োজিত হয়, যেখানে স্থানীয় হস্তশিল্পের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
তুর্কমেনিস্তানের মানুষের ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং খাবারেও তাদের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। স্থানীয় খাবারের মধ্যে প্লভ (এক ধরনের বিরিয়ানি), কেবাব, এবং লাভাশ (রুটি) অন্যতম। তুর্কমেনিস্তানে চা পান করা খুবই জনপ্রিয় এবং এটি অতিথি আপ্যায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তুর্কমেনিস্তানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো কুনিয়া উর্গেন্চ, যা একসময় খোয়ারিজম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এখানকার প্রাচীন মসজিদ, মিনার, এবং মাজারগুলি তুর্কমেনিস্তানের গৌরবময় অতীতের স্মৃতি বহন করে। এছাড়া, এখানে প্রাচীন পারসিয়ান এবং মঙ্গোল শাসনামলের নিদর্শনও পাওয়া যায়।
তুর্কমেনিস্তান তার ঐতিহ্যবাহী রীতি-নীতি রক্ষার পাশাপাশি আধুনিকীকরণেও গুরুত্ব দিয়েছে। আশগাবাতের মতো শহরগুলিতে বিভিন্ন আধুনিক স্থাপত্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখা যায়। তুর্কমেনিস্তানের অর্থনীতি মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল।
তুর্কমেনিস্তান হলো এমন একটি দেশ, যা তার মরুভূমি, ঐতিহ্য, এবং আধুনিক স্থাপত্যের জন্য ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করে। প্রাচীন সিল্ক রোডের নিদর্শন থেকে শুরু করে দরভাজা গ্যাস ক্রেটারের মতো প্রাকৃতিক বিস্ময় পর্যন্ত, তুর্কমেনিস্তান পর্যটকদের জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।